একদা গৃহকোণে

নিরন্তর ওই চিরশ্যামল স্মিতমুখের আড়ালে একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে রাখতে রাখতে চেনা বারান্দার দেয়ালগুলোর সবুজ রংটা কেমন চোটে গেছে আজ। মর্মাহত ল্যাম্পপোষ্টটা আজও নির্বিকার ভাবে বিজলীবাতি বহন করে যাচ্ছে। আর কেউ টের পাক বা না পাক, ওই পরিচিত মোড়ের বাঁকগুলো আমার সুখ দুঃখ জানে। তারা জানে দুঃখ হলে, শরীরের কোন অংশে ব্যাথা উপভোগ করি আমি। কণ্ঠের কম্পনটা কতটা তীব্র হলেও কাঁন্না আঁখিকোন অতিক্রম করে ধেয়ে বেরিয়ে আসবে না, তা শুধু তারাই বোঝে। তারাই আমার আদর্শ সঙ্গী। বৃষ্টির অনর্গল শব্দের মধ্যে - "দুজনে মুখোমুখি, গভীর দুখে দুখী, আকাশে জল ঝরে অনিবার, জগতে কেহ যেন নাহি আর।"

বৃষ্টিতে ভেজা চোখের জলগুলো শুধু মাত্র রাস্তার ধারের ল্যাম্পপোষ্ট টা চোখ মেলে দেখেছে, আর মনে রেখেছে। ছলছল উজ্জ্বল জলধারা মিলে মিশে এক হয়ে গড়িয়ে গেছে পাঁচ মাথার মোড়ে। চারিদিকে অপ্রকাশিত ম্যানুষ্ক্রিপ্টের ছেড়া মোড়ানো কাগজ গুলো কেঁদে কেঁদে বলছে, আমি এই ভাবে হারিয়ে যেতে চাইনি। চাইনি রাস্তার মাঝখানে ঝালমুড়ির ঠোঙ্গা হয়ে ঘুরে বেড়াতে। চাইনি পিয়াজ আর সর্ষে তেলের ঘ্রাণে নিঃশব্দে কাঁদতে। "কেবলই আঁখি দিয়ে, আঁখির সুধা পিয়ে, হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব।"

ভেজা শরীরে বাড়ি ফেরার পর আমার রিক্ত ঘরের করিকাঠগুলোই আমার গল্পের একমাত্র সাক্ষী। আমার চিরসখা। আমার মনের আড়ালের সব সাতপাঁচের খবর আগলে রাখে সদর দরজার খিলটা। আমার মানসিক দুর্বলতাগুলোকে কোনো অন্য মানুষের কাছে হাত ছাড়া করলে চলবে না, তাই ভেজা তোয়ালেটা নোনতা হয়ে যায়, মনের ভেতরের লবন হ্রদটা উপচে পরে। মনে পরে যায়, একাকী সন্ধ্যেগুলোর কথা, সেই দীর্ঘ অপেক্ষার কথা, সেই অগ্নিপরীক্ষার কথা। হয়তো সোনার হরিণ চাওয়াটাই প্রধান দোষ ছিল। আশ্রমের এক কোনায় বসে ভাবি - "সমাজ সংসার মিছে সব, মিছে এ জীবনের কলরব।"

হয়'ত ঠিক একই কারণে, আমার প্রকৃত বন্ধু এই দেরাজের বইগুলো, যাদেরকে আমি মনে প্রাণে চাই, আর যারা আমাকে আমার নগ্নতায় সম্পূর্ন ভাবে গ্রহণ করে। একমাত্র স্নানের ঘরের বাষ্প আমার অকৃত্রিম রূপটা দেখলে কোনো রকম অবাঞ্ছনীয় সামাজিক মতামত প্রদান করে না। আমার শরীরের সমস্ত অঙ্গকে আলিঙ্গন করে, চুম্বনে স্পর্শ করে শাওয়ারের জল। আমি যেমন, আমাকে তেমনভাবেই নিজের করে নেয়। মনে মনে ভাবি - "দু কথা বলি যদি কাছে তার।"

আপস এবং আফসোসের যুগলবন্দী আমার জীবনকে সাহায্য করে সবার কাছে ভালো হতে, স্পষ্টতই একটা সামাজিক অর্থে সার্বিক ভালোর জন্য একটি কৃত্রিম হাসি দিয়ে প্রস্তুত হতে শিখিয়েছে। ঘড়ির কাঁটার টিক টিক আওয়াজ বুঝিয়ে দেয় এই নাটকের শেষ অনিবার্য। মনে করিয়ে দেয় এই যুদ্ধের অবসান ঘটবেই। আর বেশি সময় নেই। আমি খুশি, আমি আনন্দেই আছি, কারণ ওটাই স্বাভাবিক। লোকে যখন জিজ্ঞাসা করে, হাসি মুখে আমি বলি - আমি ভালো আছি। কিন্তু, "এমন দিনে তারে বলা যায়,... এমন দিনে মন খোলা যায়?"

ইচ্ছে করে বাঁধ ভেঙে সবার জীবন প্লাবিত করে দি, ইচ্ছে করে এই রোবোটিক জীবনশৈলীর গন্ডি পার করে, প্রাণটাকে উজাড় করে দি জগতের সামনে - চেঁচিয়ে বলি আমি কি। আমি কে। রক্তমাংসের হৃদপিন্ড টা কাঁদতে চায়, চায় সমস্ত টা ব্যক্ত করতে, চায় উন্মুক্ত আকাশের মধ্যে ডানা মেলে উড়তে। কিন্তু সমাজ এবং নিয়ম শৃঙ্খলার দৃঢ়তায় ব্লাড প্রেশারটা ঊর্ধের দিকে। হাসির মাধ্যমে প্রকাশিত উচ্ছাস ও মিষ্টতাও রক্তে মিশে বানিয়েছে সুগার। স্নিগ্ধতার আড়ালে ঠাঁই পেয়েছে এক কঠোর পাষান। কিন্তু "সে কথা এ জীবনে, রহিয়া গেল মনে, সে কথা আজি যেন বলা যায়।"

আজ আমার মিষ্টতা আমাকে কুড়ে কুড়ে খায়। আমার ছদ্মবেশ আমার চিলেকোঠার রোদ্দুরটা প্রত্যাখ্যান করলেও বা কি, আমি ওটিকে আগলে রেখেছি সমাজের জন্য, বাঁচিয়ে রেখেছি আমার সামাজিক সত্ত্বা। ভিতরের মনটা আজ আর নেই। মনুষ্যত্বের বলিদান দিতে আমার কিঞ্চিৎ কুণ্ঠা হয়না। আমি আর মানুষের মধ্যে নেই। আমি আর মানুষ নই। "তাহাতে আসে যাবে কি বা কার?"

Comments