একটি অচেনা সময়

এক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন আজ আমরা সবাই। একটি অভূতপূর্ব অনিশ্চয়তার মধ্যে সকলে আছি। ভালো খবর এটা যে আপনারা যারা আমার লেখা পড়ছেন বা অন্যান্য কাজে মগ্ন, তাঁরা জীবিত, এবং সম্ভবত এখনো আক্রান্ত নন। দুঃখের বিষয় এটা যে আমরা জানিনা এই নিরাপদ আশ্রয়টি কতটা দীর্ঘস্থায়ী। 

একটি নতুন আলোয় জীবন যাপন করতে আজ মানুষ শিখে গেছে। শৃঙ্খলা ছাড়াই আমরা নিজেদের দৈনন্দিন জীবন যাপনের পদ্ধতিতে অনেকটা পরিবর্তন এনেছি। পরিস্থিতিই এমন, করতে বাধ্য হয়েছি। দরকার সীমিত হয়েছে। প্রয়োজনগুলোও অপেক্ষাকৃত কমে গেছে। যা পরিবর্তন হয়নি তা হলো আমাদের মন। এবং মনের আড়ালের সব বিবাদগুলি। 

আজ ও পাড়ার মুখার্জি দা চায়ের কাপে চুমুক না দিলে দেশের-দশের আড্ডাটা জমে ওঠে না। আলমারিতে তুলে রাখা পঁয়লা বৈশাখের নতুন ভাঁজে সাজানো পাঞ্জাবিটা বরকে না পড়তে দেখলে প্যারালাইসিসে আক্রান্ত ঘোষ কাকিমার উদাসীন বাকহীন মুখটায় হাসি ফোটে না। পচাঁদার মিষ্টির দোকানের গুজিয়া সেবন না করলে পার্থদার মনটা ছটফট করে। রায়েদের বাড়ির বারান্দা থেকে আজও বড়ভাই আর ছোটভাইয়ের মধ্যে সম্পত্তি ভাগাভাগি সম্বন্ধিত ঝগড়া শোনা যায়। কর্নেল খানের নিঃসন্তান পুত্রবধূ তাঁর শহীদ স্বামীর ফিরে আসার আশায় হিজাবের আড়াল থেকে ছবিটার দিকে তাকিয়ে বসে থাকে।

দীর্ঘ পঞ্চান্ন বছরের বৈধব্য কাটিয়েও, বিভাজনের সময়ে যে বাক্সপ্যাটরা নিয়ে এসেছিল, সেগুলিকে এখনো আগলে রেখেছে পাড়ার অন্ন পিসীমা। ওই রিকশাচালক ভুবনটা এখনো আক্ষেপ করে যে ছোটবেলায় স্কুলে যেতে পারলো না। অনিতাটা এখনো তাঁর বাবা মায়ের ব্রাত্য সন্তান বলে মনে করে নিজেকে, দুই দিদির পর বাবা মা যখন পুত্রসন্তানের আশায় ওকে পেয়েছিল, অখুশি হয়েছিল। দাদা-বৌদির বিরিয়ানি দোকানটাতে কতদিন যাবৎ শাটার পরে রয়েছে, স্বামীর ডাকাতির অভিযোগে পাঁচ বছরের কারাবাসে যাওয়ার পর থেকে বৌদির এটাই ছিল একমাত্র রোজগার, ছেলের স্কুলের মাইনে কিভাবে দেবে, ভেবে কূল কিনারা পায় না, তাই বাড়িতে বসে মাস্ক বানায় আজকাল। 

রেল লাইনের ধাঁরে বারান্দায় বসে নিস্তব্ধ রেল লাইনগুলো দেখে নীলিমাটা ভাবে অসময়ে মা বাবা তাঁকে ছেড়ে চলে গেল গতবছর, ওর বিয়েটা কে দেবে? ও কি চিরকাল অবিবাহিতই থেকে যাবে তা হলে? গ্রীষ্মকাল এসে যাবে ভেবে অনুপবাবু ভেবেছিল ছেলের পড়ার সুবিধের জন্য ইএমআইতে একটা এসি কিনবে, কোরোনায় আক্রান্ত হয়ে ছেলেটা এখন সরকারি কোরোনা সেন্টারে মৃত্যুর সাথে যুজছে।

এত কিছুর মধ্যেও মানুষের দ্বন্দ্বগুলি রয়ে গেছে। রয়ে গেছে সকলেই ছুটেছে গৃহবন্দি হওয়া থেকে মুক্ত হতে, কিন্তু এই অন্তর্দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তির উপায় কি? তার সমাধান কই? 

এই নববর্ষে আমি বিধাতার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করি যেন সকলে এই দ্বন্দ্বের সমাধান খুঁজতে সক্ষম হয়। কোরোনা মহামারীর মাধ্যমে নিজেদের জীবনের ব্যস্ততা থেকে    আমরা যেটুকু সময় কুড়িয়ে পেয়েছি, সেই সময়ের কিছুটা অংশ ব্যবহার করে নিজেদের দ্বন্দ্ব গুলি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করি। আসুন সকলে মিলে এক নব আনন্দে জেগে উঠি।

শুভ নববর্ষ ১৪২৭ বঙ্গাব্দ।

Comments